হযরত সালেহ (আঃ) এর জীবনী
হযরত সালেহ (আঃ) ছিলেন আল্লাহর প্রেরিত এক মহৎ নবী, যাঁকে সমূদ জাতির প্রতি প্রেরণ করা হয়েছিল। কুরআন ও হাদিসের বিবরণ অনুযায়ী, সমূদ জাতি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী, ধনী এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত। তারা পাহাড় কেটে ঘর নির্মাণ করত এবং তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা অহংকার ও কুফরিতে লিপ্ত ছিল।
সমূদ জাতি ও সালেহ (আঃ) এর দাওয়াত
সমূদ জাতি ছিল নূহ (আঃ)-এর বংশধর। তারা আল্লাহর দেয়া সীমাহীন নিয়ামত ভোগ করেও কুফরি করত এবং মূর্তিপূজায় লিপ্ত ছিল। তাদের মধ্যে অনৈতিকতা ও অন্যায় কাজ ব্যাপক ছিল। এই পরিস্থিতিতে আল্লাহ তাদের সঠিক পথে আনার জন্য হযরত সালেহ (আঃ)-কে নবী হিসেবে পাঠান। তিনি তাদের প্রতি দাওয়াত দেন যে তারা এক আল্লাহর ইবাদত করুক এবং পাপ থেকে বিরত থাকুক।
সালেহ (আঃ) বারবার তাদের সত্যের পথে আসার আহ্বান জানান এবং তাদের সতর্ক করেন। তিনি তাদের বোঝান যে তাদের এই শক্তি ও ঐশ্বর্যও আল্লাহর দেয়া এবং একদিন আল্লাহর সামনে তাদের জবাবদিহি করতে হবে।
উটনীর অলৌকিক নিদর্শন
সমূদ জাতি সালেহ (আঃ)-এর দাওয়াত গ্রহণ না করে তার
কাছে অলৌকিক নিদর্শন চেয়েছিল। আল্লাহ তাদের জন্য একটি বিশেষ নিদর্শন পাঠালেন।
সালেহ (আঃ)-এর দোয়ার পর আল্লাহ তাদের সামনে একটি বিশাল আকৃতির উটনীকে সৃষ্টি করেন, যা পাহাড় থেকে
বের হয়েছিল।
এই উটনী ছিল আল্লাহর নিদর্শন। সালেহ (আঃ) তাদের বলে দেন যে তারা যেন এই উটনীকে সম্মান করে এবং তাকে কোনো ক্ষতি না করে। উটনী পানি পান করার সময় তারা যেন তার পথে বাধা না দেয়।
সমূদ জাতির অস্বীকার ও ধ্বংস
সমূদ জাতি, যাদের প্রতি হযরত সালেহ (আঃ) প্রেরিত হয়েছিলেন, তারা আল্লাহর একত্ববাদ ও নবীর দাওয়াতকে অস্বীকার করেছিল। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে (বিশেষ করে সুরা হুদ, সুরা শুআরা, সুরা আল-আরাফ এবং সুরা আশ-শামস) এই জাতির ঘটনাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।
সালেহ (আঃ)-এর সতর্কবার্তা
হযরত সালেহ (আঃ) তাদের সতর্ক করেছিলেন যে তারা যদি নিজেদের পাপাচার ও অবাধ্যতা থেকে ফিরে না আসে এবং আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে অস্বীকার করে, তবে তাদের ওপর আল্লাহর গজব নেমে আসবে। তিনি তাদের বারবার বুঝিয়েছিলেন যে আল্লাহ তাদের অনেক নিয়ামত দিয়েছেন—উর্বর জমি, পাহাড় খোদাই করে তৈরি শক্তিশালী বাড়ি এবং উন্নত জীবনধারা। কিন্তু তারা এই সব নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে আল্লাহর সাথে শরিক স্থাপন করেছিল এবং নিজেদের শক্তি ও সম্পদের প্রতি অহংকার করত।
উটনীকে হত্যা
সমূদ জাতি সালেহ (আঃ)-এর চ্যালেঞ্জে জবাব দেওয়ার জন্য
একটি অলৌকিক নিদর্শন চেয়েছিল। তখন আল্লাহ তাদের জন্য একটি বিশেষ উটনী পাঠালেন, যা পাহাড় থেকে
বের হয়েছিল। সালেহ (আঃ) তাদের বলেছিলেন,
- উটনী আল্লাহর নিদর্শন, তাকে যেন
কোনো ক্ষতি না করা হয়।
- উটনীকে পানি পান করার জন্য তার দিন নির্ধারিত ছিল, এবং সমূদ জাতির জন্য তাদের পানির দিন ছিল।
তবে, তাদের অবাধ্যতা আরও বেড়ে যায়। একদল ষড়যন্ত্রকারী উটনীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। এই ষড়যন্ত্রের নেতা ছিল কুফরি ও অবাধ্যতায় লিপ্ত কিছু লোক। অবশেষে, তারা উটনীকে হত্যা করে। উটনী হত্যার ঘটনা সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে:
ধ্বংসের ঘোষণা
উটনী হত্যার পর, সালেহ (আঃ) তাদের বললেন:
এই তিন দিন তাদের জন্য শেষ সতর্কবার্তা ছিল। তারা
উপহাস করে বলেছিল যে এই শাস্তি কখনও আসবে না।
গজবের প্রক্রিয়া
তৃতীয় দিনের পর, আল্লাহ তাদের ওপর ভয়ংকর গজব পাঠান।
1.
প্রথমে এক ভয়ংকর
বজ্রধ্বনি (সাইহাহ): এর শব্দ এত ভয়াবহ ছিল যে তা তাদের হৃদয়কে
চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়।
2.
ভূমিকম্প (রাজফা): তাদের বিশাল
পাহাড় কাটা শক্তিশালী ঘরগুলো তাদের কোনো রক্ষা করতে পারেনি। পুরো এলাকা
ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
3.
গভীর নীরবতা (তাহলুক): ধ্বংসের পর সমূদ
জাতি একটি নীরব ধ্বংসপ্রাপ্ত সম্প্রদায় হয়ে যায়।
কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে:
শিক্ষণীয় বার্তা
সমূদ জাতির ধ্বংস থেকে আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ
শিক্ষা রয়েছে:
1.
অলৌকিক নিদর্শন
উপেক্ষার ফল: আল্লাহর নিদর্শন ও সতর্কবার্তাকে অবজ্ঞা করা সর্বদা
ধ্বংস ডেকে আনে।
2.
আল্লাহর অবাধ্যতার
শাস্তি: যারা অহংকার ও পাপাচারে লিপ্ত, তারা আল্লাহর
শাস্তি থেকে রক্ষা পায় না।
3.
নবীদের
সতর্কবার্তা গুরুত্বের সাথে নেওয়া: নবীদের কথা ও
দাওয়াত সর্বদা আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্যের বার্তা বহন করে।
4.
আল্লাহর বিধানের
প্রতি আনুগত্য এবং অহংকার ও কুফরি পরিহার করা আবশ্যক।
5.
আল্লাহর নিদর্শন
অস্বীকারের ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ।
6. একজন নবীর দাওয়াত সর্বদা সত্যের পথে থাকে, এবং তাকে প্রত্যাখ্যান করলে শাস্তি অবধারিত।